যুবায়ের হাসান
সালটা ১৯৩১, হঠাৎই ঠিক হয়েছিল, মহালয়ার ভোরে এক প্রভাতী অনুষ্ঠান করা হবে এবং সেটা সরাসরি সম্প্রচার হবে অলইন্ডিয়া রেডিওতে বাংলায়। কিন্তু সমস্যা দাঁড়াল অন্য জায়গায় – “কায়েতের ছেলে (বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র) আবার চণ্ডীপাঠ করবে কি?” সে তো জাতে ব্রাহ্মণ নয়!
তখন অনুষ্ঠানের দ্বায়িত্বে থাকা নৃপেন মজুমদার জানালেন – “অনুষ্ঠান করবে, তার আবার বামুন-কায়েত কী হে? আমাদের এই অনুষ্ঠানে যাঁরা বাজাবেন, তাঁরা তো অর্ধেকেরও বেশি মুসলমান! তা হলে তো তাঁদের সকলকে বাদ দিয়ে ব্রাহ্মণদের ডেকে আনতে হয়।”
সেই সরাসরি সম্প্রচারে সারেঙ্গী বাজিয়েছিলেন মুনশি, আলি বাজিয়েছেন চেলি আর হারমোনিয়ামে সুর ধরেছিলেন খুশি মহম্মদ। কণ্ঠে কায়েতের ছেলে বীরেন্দ্র কৃষ্ণভদ্র। স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন বাণী কুমার।
প্রতি বছর মহালয়ার ভোরে যে সুর আর কণ্ঠ আমাদের গায়ে কাঁটা দেয়, তার সৃষ্টিতে আছে এমন এক মেলবন্ধন।
সেদিনের অলইন্ডিয়া রেডিও, মানে আজকের আকাশবাণীতে চণ্ডীপাঠের শুরুটা নিয়ে দীপু মণ্ডলের লেখাটি ছিল এমনটাই।
বন্ধু সঞ্জয় কুমারের অনেকদিন আগের একটা ছোট্ট স্ট্যাটাসও এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, ‘‘আমরা সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কী করব? আজো বিসমিল্লাহ খান সাহেবের সানাইয়ের মাধুর্য্য আর মুসলমান কারিগরদের তৈরি বেনারসী শাড়ি ছাড়া হিন্দু বাড়ির বিয়ে পরিপূর্ণতা পায় না, সব পরিচয় বাদ রেখে তাই তো মানুষ হিসেবেই পরিচয় দিতে চাই।’’
লেখাগুলোর মর্মমূলে যেতে পারলে, সব ছাড়িয়ে মানুষ নামের পরিচয়টাই বড় হয়ে ওঠে। সনাতন ধর্মের মানুষেরা যেমন প্রতিবেশি সম্প্রদায়ের ওপর কোনো না কোনোভাবে নির্ভরশীল, তেমনি সেই প্রতিবেশিরাও নির্ভরশীল তাদের প্রতিবেশিদের ওপর। বিভেদের নকল চশমা খুলে খোলা মনে আশপাশে দেখলেই এই পরস্পরনির্ভরশীলতা, অভিন্নতা দেখতে পাবেন খুব স্পষ্টভাবে। দু’দিকের অনেকেই অবশ্য বিভাজনের জঞ্জাল ছাড়া বিশেষ কিছু দেখতে পান না, তারা বংশ পরম্পরায় বিদ্বেষের বিষ বয়ে বেড়াচ্ছেন আর সে অসুখ সারার কথাও নয়।
বাস্তবে আমরা কিন্তু একজন আরেকজনের হাত ধরাধরি করে চলেছি সেই হাজার বছর ধরে। মুখের বুলি, খাদ্যাভ্যাস, আচার আচরণ, গানবাজনার মতো হাজারো অনুষঙ্গ নিয়ে আমাদের সংস্কৃতির শেকড় বাংলা নামের ভূ-ভাগের মাটিতে অনেক গভীরে পোঁতা। প্রসঙ্গক্রমে বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী ডঃ শহীদুল্লাহ’র এই কথাটিও মনে পড়ছে – ‘‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। মা-প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায়, ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো-টি নেই।’’
সব ভুলে আসুন তাই বাঙালি হতে চেষ্টা করি, একই সঙ্গে মানুষ হয়ে বিশ্বসমাজের সভ্য নাগরিক হই। একজন আরেকজনকে সম্মান করতে শিখি। প্রতিবেশির ‘ঈদ মোবারক’ এর জবাবে ‘পূজোর শুভেচ্ছা’ উঠে আসুক আপনাআপনিই। সনাতন ধর্মাবলম্বী সমাজের সবচেয়ে বড় উৎসবের মুখে বন্ধুদের জন্য রইল মনখোলা শুভেচ্ছা। উৎসব জয়যুক্ত হোক, বন্ধুত্ব বেঁচে থাক।
Leave a Reply