অনুলিপিত ইন্টারনেট থেকে
আজ ২৬ সেপ্টেম্বর। ভারতীয় নবজাগরণের প্রাণপুরুষ, পার্থিব মানবতাবাদী ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ২০৪ তম জন্মদিবস।
সামন্তী ধর্মীয়প্রথা, কুসংস্কার, জাতপাত, প্রবল সংকীর্ণতা, ব্রাহ্মণ কুলের দাপট, অশিক্ষা প্রভৃতির অন্ধকারে জর্জরিত ঊনবিংশ শতাব্দীর এদেশের সমাজ।
বিজ্ঞান ও যুক্তিভিত্তিক ইউরোপীয় নবজাগরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে ধর্মীয় সংস্কারের পথেই প্রথম নবজাগরণের সূচনা করে, প্রথম সমাজ সংস্কারে উদ্যোগী হয়েছিলেন রাজা রামমোহন রায়।
এরপর বিদ্যাসাগর মহাশয় ধর্ম সংস্কারের পথে না গিয়ে, সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পথে এক নতুন ধরনের সমাজ ব্যবস্থা প্রবর্তনের সূচনা করলেন। ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও বিজ্ঞানসম্মত চেতনার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা চারিত্রিক দৃঢ়তা- অজেয় পৌরুষ- অক্ষয় মনুষত্ব সম্পন্ন বলিষ্ঠ এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি।
হাঁটুর ওপর কাপড় পরা, মাথায় টিকি প্রভৃতি দেখে তাঁকে একজন নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণ মনে হলেও, আপাদমস্তক তিনি ছিলেন একজন খাঁটি পার্থিব মানবতার চেতনা সম্পন্ন সম্পূর্ণ এক নতুন ধরনের মানুষ। ধর্মকে ভিত্তি করে সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনাকে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করতেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “ধর্ম যে কি, মানুষের বর্তমান অবস্থায় তা জানার উপায় নেই, এবং জানবার দরকার নেই। ধর্মের তত্ত্ব কী, এ নিয়ে তর্কাতর্কির বোধ করি কোনকালেই মীমাংসা হবে না। এ তর্ক চিরকাল চলবে।” এ দেশীয় সভ্যতার সাথে পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান সভ্যতার যুক্তিভিত্তিক সংযোগ সাধন করিয়েছিলেন তিনি। দেশের মানুষকে ভ্রান্ত দর্শনের প্রভাব থেকে মুক্ত করে উন্নত সাহিত্য, গণিত, লজিক ইত্যাদি এক কথায় ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বস্তুবাদী দর্শনের সাথে পরিচিত করান তিনি।
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের চরিত্রের যে দিকটি প্রায় আলোচিত হয়না, তা হল তিনি অলৌকিক ক্রিয়া, অতিপ্রাকৃত স্বত্তা, ঈশ্বর-আল্লা বা ধর্মীয় আচার আচরণ পূজা-আহ্নিকে কখনও বিশ্বাস করতেন না।
তিনি যখন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিলেন তখন অধ্যাত্মবাদের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাভাবনার প্রচার করতে চেয়েছিলেন এই পত্রিকায়। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে এ বিষয়ে মতভেদ হওয়ায় তিনি পত্রিকার সাথে সম্পর্ক ছেদ করতে বাধ্য হন।
ঈশ্বর প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, “ঈশ্বরকে ডাকবার কি দরকার! চেঙ্গিস খাঁ যখন লুটপাট আরম্ভ করলে তখন অনেক লোককে বন্দী করলে, ক্রমে ক্রমে এক লক্ষ বন্দী জমে গেল। তখন সেনাপতি এসে বললেন, মহাশয় এদের খাওয়াবে কে? তখন চেঙ্গিস খাঁ বললেন, তাহলে কি করা যায়, ওদের সব বধ কর।… এই হত্যাকাণ্ড তো ঈশ্বর দেখলেন? কই একটু নিবারণ তো করলেন না। তা তিনি থাকেন, থাকুন, আমার দরকার বোধ হচ্ছে না।”
তিনি কখনো মন্দিরে যাননি। তাঁর বাবা-মা’র সাথে কাশীতে দেখা করতে গিয়ে সেখানে একবার পান্ডার দল মন্দিরে যাওয়ার জন্য টানাটানি করায়, তিনি বলেছেন- ‘আমি ওসব মানি না। আমার বাবা বিশ্বেশ্বর আর মা অন্নপূর্ণা, এর বাইরে আর কাউকেই আমার মানার দরকার নেই। তাঁর নিজের রচিত ‘জীবনচরিত’ বইয়ে কোথাও কোন ঈশ্বর-অবতারের উল্লেখ তিনি করেননি।
ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত ও কুসংস্কারমুক্ত করতে চেয়েছিলেন তিনি। ১৮৪১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যোগদানের পর শিক্ষাদানের প্রয়োজনে এবং মার্শাল সাহেবের পরামর্শে তিনি ভালোভাবে ইংরেজি শেখা আরম্ভ করেন। পাশ্চাত্য দর্শনের সাথে এদেশের ধর্মশাস্ত্রের তুলনা করে তিনি বুঝেছেন, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও বিবিধ দেশাচারে নিমজ্জিত দেশবাসীর উন্নতি, যুক্তিবিচার ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির চর্চার দ্বারাই সম্ভব। আর তার জন্য চাই পাশ্চাত্যের উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা। তিনি বলেছেন, “……..আমাদের দেশের সাংখ্য ও বেদান্ত যেমন ভ্রান্ত দর্শন তেমনি ইউরোপের বার্কলের দর্শনের মধ্য দিয়েও ঐ একই ধারণা প্রতিফলিত।” তাই তিনি ব্যালেন্টাইনের বার্কলের দর্শন পড়ানোর মতের বিরুদ্ধতা করেছিলেন। একদিকে তিনি নতুন পাঠ্যসূচি, নতুন নতুন পাঠ্যপুস্তক এবং বৈজ্ঞানিক ধ্যান ধারণার ও যুক্তিবাদের শিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষক যেমন চেয়েছিলেন; অন্যদিকে শিক্ষা যাতে শুধুমাত্র অভিজাতদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে, সমাজের আপামর জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে তার জন্যও সচেষ্ট হয়েছিলেন তিনি।
দেশীয় ভাষায় শিক্ষা দানের প্রয়োজনে দেশীয় ভাষার উন্নতিসাধন করতে চেয়েছিলেন তিনি। সংস্কৃত কলেজে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাষা বিকাশের জন্য সংস্কৃত পড়া যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুই চাই, এর বেশি নয়- নিছক সংস্কৃত শাস্ত্র পড়ার জন্য নয়।’ তিনি বলতেন, ‘সংস্কৃতে অংক শেখানো খুব জটিল কাজ এবং সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে শেখানো হোক, সংস্কৃত ভাষার তুলনায় অর্ধেক সময়ে অংক শিখবে।’
আরও বলতেন, ‘শিক্ষা বলতে শুধু রিডিং, রাইটিং ও অ্যারিথমেটিক নয়, যথার্থ ও পূর্ণ শিক্ষা দাও। ভূগোল, জ্যামিতি, সাহিত্য, ন্যাচারাল ফিলোজফি , ফিজিওলজি, পলিটিক্যাল ইকোনমি ইত্যাদি শিক্ষা দরকার।’ ব্রিটিশ পরিচালিত কেরানি – আমলা তৈরির শিক্ষাব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক- ধর্মনিরপেক্ষ- মানবতাবাদী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন তিনি।
তিনি বাল্য ও বহুবিবাহ রোধ এবং বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের সংগ্রাম করেন। বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের জন্য তাঁকে সেদিন হিন্দু সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছিল। তৎকালীন সমাজপতিদের প্রবল বাধা ও আক্রমণের সম্মুখীন হয়েও দমানো যায়নি তাঁকে। তিনি ধর্মে অবিশ্বাসী হয়েও, ধর্মশাস্ত্রকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বিধবা বিবাহের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করানো ও প্রচলন করেন তিনি। কারণ, তিনি বুঝেছিলেন, তৎকালীন সমাজে শাস্ত্রীয় চিন্তার বীজ ছিল বেশ গভীরে, তৎকালীন সমাজপতিদের কাছে যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে গেলে এই পথেই তা সম্ভব।
পুত্র নারায়ণ বিধবা বিবাহের সিদ্ধান্ত নিলে তিনি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তিনি বলেছেন যে, ‘নারায়ণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এই বিবাহ করিয়া আমার মুখ উজ্জ্বল করিয়াছে।’ সেখানে আত্মীয়দের বাধা ও আপত্তিকে তুচ্ছ করে বলেছিলেন, “আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নহি; নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যাহা উচিত আবশ্যক বোধ হইবে, তাহা করিব। লোকের বা কুটুম্বের ভয়ে কদাচ সংকুচিত হইব না।” আবার তার সেই ছেলে যখন স্ত্রীর সাথে খারাপ আচরণ করে তখন তাঁর বাবা-মা -স্ত্রী -ভাইদের প্রবল আপত্তি অগ্রাহ্য করেই ছেলেকে তাজ্য ঘোষণা করেছিলেন তিনি।
আজ আমরা এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে চলেছি। বিদ্যাসাগর মহাশয় জন্মের ২০০ বছর অতিক্রান্ত। আজও সামন্তী ধর্মীয় অন্ধতা, বিবিধ কুসংস্কার, জাত-পাতের বিভেদ, প্রাচীন ঐতিহ্যের নামে অপবিজ্ঞানের প্রচার প্রসার ও অবৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণায় সমাজকে নিমজ্জিত করার অপচেষ্টা চলছে। একে রুখতে আজ চাই বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শিক্ষাকে পাথেয় করে যুক্তিশীল মনন ও বিজ্ঞানভিত্তিক নৈতিকতার ভিত্তিতে এক নতুন ধরনের বিজ্ঞান আন্দোলন।



তথ্যসূত্র:-
১) প্রকৃতি; জানুয়ারি’২০২০
২) মহামানব বিদ্যাসাগর; বিদ্যাসাগর স্মরণ সমিতি
৩) ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর; প্রভাস ঘোষ
Leave a Reply