বনবিবির উপাখ্যান

সিদ্ধব্রত দাস

[লেখক জাতীয় বাংলা সম্মেলন এর সভাপতি]

আঠারো ভাটির মায়ের আজ মহা উৎসব

“মা বনবিবি, তোমার বাল্লক এলো বনে,
থাকে যেন মনে।
শত্রু দুষমন চাপা দিয়ে রাখ গোড়ের কোণে।।
দোহাই মা বরকদের, দোহাই মা বরকদের।”

আজ আঠারো ভাটির দেশ ‘সুন্দরবনে’ মা বনবিবির পূজা।”বনবিবির জহুরানামা” অনুসারে মক্কা থেকে আসা ইব্রাহিম ও তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী গুলালবিবির সন্তান মা বনবিবি। ইব্রাহিমের স্ত্রী গুলাল বিবি সতিনের প্ররোচনায় সুন্দরবনে পরিত্যক্ত হন। কয়েকদিন পর সেখানেই যমজ পুত্র-কন্যার জন্ম দিয়ে তার মৃত্যু হয়। সদ্যোজাত শিশু দু’টির কান্না শুনে বনের বাঘ, কুমির, হরিণ, অজগর, বানস সবাই ছুটে আসে। তারাই দুই ভাইবোনকে লালনপালন করে বড়ো করে তোলে। বড় হয়ে ছেলেটি শা-জাঙ্গলী এবং মেয়েটি বনবিবি নামে পরিচিত হয়।

সুন্দরবনের প্রধান দণ্ড রক্ষ মুনীর সন্তান দক্ষিণরায় ছিল এই দেশের অত্যাচারী রাজা যারা তাকে নরমাংস উৎসর্গ করতো না তাদের বাঘের রূপে এসে হত্যা করতেন। বনবিবির সঙ্গে দক্ষিণরায়ের ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয় এবং সেই যুদ্ধে দক্ষিণরায় পরাস্ত হয়। সেই থেকে বনবিবি হয় ওঠে সুন্দরবনের রক্ষার্থী দেবী।

সুন্দরবনে মা বনবিবির পুজা না করে জঙ্গলে জেলেরা মাছ ধরতে কিংবা মৌলিরা মধু কাটতে বা মোম সংগ্রহ যান না। একবার দুই মৌলি ধোনা আর মোনা জঙ্গলে মধু কাটতে গেছিল এবং সঙ্গে ছিল তাদের ভাইপো দুখে। দুখে খুবই গরিব ঘরের, বাবা চলে গেছে, মায়ের এক মাত্র ভরসা সে। মায়ের অসুস্থ্যতার কারণে ছেলে সেই বালক বয়সেই কাজে নেমে যায়। ধোনা, জঙ্গলে যাওয়ার আগে দক্ষিণরায়ের পুজো দিতে ভুলে গেল। রাতে সে দক্ষিণরায়ের থেকে স্বপ্নাদেশ পায় এই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে তাকে নরমাংস উৎসর্গ করতে হবে, তাহলেই সে জঙ্গল থেকে মধু আর মোম নিয়ে যেতে পারবে। পরের দিন তারা দুখেকে জঙ্গলে ছেড়ে চলে যায়। গ্রামে এসে সবাইকে বলে দুখেকে বাঘে খেয়ে নিয়েছে।

দুখের মা কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয় যায়। ঐদিকে জঙ্গলে দুখেকে খেতে বাঘ রূপে আসে দক্ষিণরায়। দুখে মা মা করে তিনবার ডেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তার আর্তনাদ শুনে মা বনবিবি তার ভাই শা জাঙ্গলীকে পাঠান এবং সেখানে দক্ষিণরায়ের সাথে যুদ্ধ হয়, যুদ্ধে পরাস্ত হয় দক্ষিণরায় সেখান থেকে পালিয়ে গাজীর দরবারে শরণাপন্ন হন। গাজীর প্রার্থনায় মা বনবিবির সাথে অবশেষে দক্ষিণরায়ের বিবাদ মেটে। দক্ষিণরায়কে শান্তির প্রতিজ্ঞা করিয়ে মা বনবিবি বলেন-

“আঠারো ভাটির মাঝে আমি সবার মা।
মা বলি ডাকিলে কার বিপদ থাকে না।
বিপদে পড়ি যেবা মা বলি ডাকিবে।
কভু তারে হিংসা না করিবে।”

মা বনবিনি দুখেকে প্রচুর ধনরত্ন দিয়ে সেকো তার বাহন কুমিরের সাথে গ্রামে পাঠিয়ে দেন। এবং পরবর্তীতে সে হয় ওঠে সুন্দরবনের প্রধান এবং আজকের এই দিন পয়লা মাঘ শুরু করেন মা বনবিবির পুজা।

সুন্দরবনের হিন্দু, মুসলমান সকলের মা বনবিবি। একদিকে হিন্দুরা মনে করেন মা হলেন চন্ডীর এক রূপ। অন্য দিকে মুসলমানরা মনে করেন আল্লা পাঠিয়েছেন মা বনবিবিকে সুন্দরবন রক্ষা করতে। মা বনবিবির পুজায় কোনো মন্ত্র থাকে না, কোনো পুরোহিত পৌরোহিত্ত্ব করে না। এই পূজা হয় ভক্তি আর ভালোবাসা দিয়ে। বাংলার লৌকিক দেব দেবীদের অন্যতম প্রচলিত দেবী মা বনবিবি।

Leave a Reply

%d bloggers like this: