History of Howrah

Received from internet

হাওড়ার ভূগোল :- খাল বিল দিঘি দহ।
“হাওড়” শব্দ থেকে হাওড়া, বহু চর্চিত এই শব্দ বন্ধ প্রায় সকলেরই জানা। হাওড় শব্দের অর্থ নিচু জলা জমি , খানা-খন্দ পূর্ণ। আর স্থান হিসাবে হাওড়া নামটি প্রথম পাই যখন ঔরঙ্গজেবের প্রপৌত্র ফারুকশিয়ার অষ্টদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে হাওড়ার পাঁচটি গ্রাম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে লিজ দিয়েছিলেন । এই পাঁচটি গ্রামের ইংরেজি বানান এই রকম salika, harrirah cassundeash, ramkrishnopur এবং battor। কোনো সন্দেহ নেই হাওড়া নামের উদ্ভব তার পর । কিন্তু তার আগে, নাম থাকুক বা না থাকুক, হাওড়া হাওড়াতেই ছিল । এবং অতি অবশ্যই জলা জমি খাল বিল দিঘি দহ পরিপূর্ণ ছিল । যা আর আজ নেই। আজকের হাওড়াকে দেখে সে যুগের হাওড়া কে চেনা অসম্ভব ।আমাদের এবারের চর্চা হাওড়ার খাল বিল দীঘি দহ।

আসুন সুদূর অতীতের হাওড়ার একটা মোটামুটি ছবি আঁকি। অনেকটা ত্রিভুজ আকৃতির হাওড়ার পূর্বে ভাগীরথী, দক্ষিণ – পশ্চিমে রূপনারায়ণ, মাঝে দামোদর বয়ে চলেছে । তার সাথে বয়ে চলেছে সেকালের সরস্বতী । আর কানা দমোদরের মত বেশ কিছু উপনদী। আর এরই সাথে মাকড়সার জলের মত ছোটো বড় বহু খাল বিল দীঘি দহ জল প্রবাহ । ঘোর বর্ষায় সব জল প্রবাহ একে অপরের সাথে মিশে গিয়ে এক মহা সমুদ্রের চেহারা নিতো। খুব উঁচু স্থানগুলি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত জেগে থাকতো । সে সময় একমাত্র যান নৌকা। জনসংখ্যার বৃদ্ধির সাথে সাথে ভুপ্রকৃতির অনেক পরিবর্তন হতে থাকলো । নাম গোত্র হীন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলপ্রবাহগুলি কিছুটা প্রাকৃতিক কারণে আর অনেকটাই মানুষের কারণে ভরাট হয়ে বাড়ী ঘর দোর জনপদে পরিণত হল । তবু তার মধ্যে নামকরা কিছু বিখ্যাত খাল / জলপ্রবাহ এখনো টিকে আছে । যদিও সেকালের তুলনায় বর্তমানে তাদের চেহারার অনেক পরিবর্তন হয়েছে । বিখ্যাত কিছু খালের কথা বলি ।

গাইঘাটা বাকসি খাল :- এই খালটির বৈশিষ্ট্য হল এটি দামোদর নদ ও রূপনারায়ণ নদ কে সংযুক্ত করেছে । এক সময় নৌযোগে এই খাল দিয়ে দামোদর থেকে রূপনারায়ণএ লোক যাতায়াত করতো । সে সময় এটা একটা বাণিজ্য কেন্দ্রও ছিল বটে ।খালটির দৈর্ঘ্য মোটামুটি সারে সাত মাইল। বর্তমানে পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট খালটির রক্ষাণবেক্ষণ করে ।

গৌরীগঙ্গা খাল :- এক সময় এই খাল ছিল নামকরা খাল । জলপ্রবাহ ছিল প্রচুর । নৌ চলাচলের উপযুক্ত ছিল । একসময় চওড়ায় এর বিস্তৃতি ছিল প্রায় ৭০ / ৮০ ফুট। একসময় এটি দামোদরের সাথে সরস্বতীর সংযোগ ঘটিয়েছিল । তারপর বাউরিয়ার কাছে এটি গঙ্গায় মিশেছে । পরবর্তী কালে এটির বিভিন্ন অংশ মজে যায়। অর্থাৎ চড়া পড়ে যায়। এবং চড়া পড়লে যা হয় তাই, বাড়ী ঘর দোর রাস্তা তৈরী হয়ে যায়। যেমন ধরুন কাজীর চড়া শ্যামসুন্দর চড়া , মোল্লার চড়া , চড়া শুড়িখালি, পাঁচলার চড়া ইত্যাদি। এই খালের কিছু অংশ সংস্কার করা হয়েছে ।

বালী খাল :- বালি খালের নাম জানেনা এ রকম লোক হাওড়ায় নেই। হাওড়ার সর্ব উত্তর -পূর্বে বালি গ্রাম আর হুগলীর সর্ব দক্ষিণ – পূর্বে উত্তরপাড়া। আর সমান্তরাল ভাবে পূর্বে বয়ে চলেছে গঙ্গা। উত্তরপাড়া আর বালিকে পৃথক করেছে যে খাল সেটি হল বালি খাল । গঙ্গায় এর উৎপত্তি তারপর পশ্চিম দিকে এগিয়ে হুগলীর শেওড়াফুলি খাল এ এসে পড়েছে । এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ মাইল।

মেদিনীপুর খাল :- এর নাম মেদিনীপুর খাল কেনো তা বলতে পারবো না। এটি উলবেরিয়ার গঙ্গা থেকে উৎপত্তি হয়ে বাঁশবেড়িয়ার কাছে দামোদরের সাথে মিশেছে । তারপর এটি আবার রূপনারায়ণ এর সাথে মিশেছে । জল সেচের জন্য এই খালটির বিশেষ গুরুত্ব আছে।

মিঠা কুন্ডু খাল :- দামোদর থেকে উৎপন্ন হয়ে ৬ মাইল প্রবাহিত হবার পর মিঠা কুন্ডু নামক স্থানে গঙ্গায় মিলিত হয়েছে। আন্দুল রোড ধরে বকুলতলা পেরিয়ে পশ্চিম দিকে এগোলে একটি খাল পেরিয়ে আপনাকে যেতেই হবে সেটিকে লোকে বলে হাঁস খালি পোল। পোল থেকেই দেখতে পাবেন তলা দিয়ে বয়ে চলেছে হাঁস খালি খাল। এটির সঙ্গে গঙ্গার সরাসরি যোগ আছে । ঠিক এই রকম আরো অনেক ছোটো বড় খাল গঙ্গায় এসে মিশেছে । এছাড়া আছে আরো বেশ কিছু খাল। যেমন মজে যাওয়া সরস্বতীর নিচের দিকের অংশকে লোকে বলে সাঁকরাইল খাল । তেমনি কানা দামোদর বা কৌশিকী নদীর নিম্ন ভাগের অংশকে লোকে বলে সিজবেরিয়া খাল ।দামোদরে যে খাল গুলি মিশেছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মাদারিয়া খাল। এটি হুগলী জেলার চাঁপাডাঙ্গার কাছে উৎপন্ন হয়ে হাওড়ার আমতার কাছে দামোদরে এসে মিশেছে । এছাড়া আছে বাঁসপাতি খাল । রূপনারায়ণ এ মিশেছে যে খাল গুলি তারমধ্যে বাকসি খালের কথা আগেই বলেছি। এ ছাড়া আছে ডাকাতিয়া রাজপুর ও স্টুয়াট খাল।

হাওড়া জুড়ে বেশ কিছু নামী অনামী জলা আছে । জলা অর্থাৎ নিচু জমি , যেখানে বর্ষা কালে জল পূর্ণ থাকে। আমি নিজের দেখা কিছু দৃশ্য বর্ণনা করছি । ৬০-৭০ দশকে হাওড়া ময়দান থেকে শিয়াখালা, আমার মামার বাড়ী, যেতাম মার্টিন ট্রেনে। ময়দান পেরিয়ে কোণা এলেই জানলা দিয়ে দেখতাম একপাশে রেল লাইনের সমান্তরাল বিশাল জলা জমি, কচুরি পানায় ভর্তি। লোকে একে কোনার জলা বলতো। হয়তো এখন সে সব ভরাট করে বাড়ী ঘর দোর হয়ে গেছে । হাওড়ায় অনেক স্থানের নামের সঙ্গে জলা শব্দ পাই। জলা ভরাট হয়ে গেছে কিন্তু নামটা থেকে গেছে । হাওড়া শিবপুরের বিখ্যাত ডুমুরজলা তারই উদাহরণ । বর্তমানে এখানে খেলার মাঠ স্টেডিয়াম তৈরী হয়েছে ।যাই হোক অচল বাবুর হাওড়া জেলার ইতিহাস থেকে আর যে সব জলার নাম পাচ্ছি সেগুলি হল আমতার কেঁদোর জলা, উলুবেড়িয়ায় কচুয়ার বিল ইত্যাদি । প্রাকৃতিক খাল ছাড়া মানুষের তৈরী খাল ও হাওড়ায় আছে এগুলিকে লোকেরা বলে কাটা খাল । যেমন উলুবেড়িয়া কেনেল, যেটি পাষান্ডপুর থেকে উলুবেড়িয়া গঙ্গায় পড়েছে । আরেকটি কলাপুরের কাছে রূপনারায়ণ থেকে দামোদর ।জলনিকাশের জন্য অনেক খাল আছে, তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য রাজপুর ড্রেনেজ খাল, হাওড়া ড্রেনেজ খাল । হাওড়ায় একসময় ছিল অনেক নামকরা দীঘি এবং দহ। দহ শব্দটার সাথে হাওড়া বাসী সুপরিচিত । দহ শব্দের অর্থ বিশাল জলাশয় ।হাওড়ার বহু স্থানের নামের শেষে দহ শব্দটা যুক্ত। যেমন মাকড়দহ ঝাপড়দহ , ভান্ডারদহ । এক সময় বেগবতী নদী সরস্বতী বয়ে যেত এই স্থান দিয়ে। সরস্বতী মজে গেলেও তৈরী হয়েছিল বিশাল বিশাল দহ। আজ আর তা নেই শুধু রয়ে গেছে নাম টুকু। হাওড়া বিশাল বিশাল দীঘি আছে । সেই সব দীঘিতে মাছ চাষ হয় । হাওড়ায় বিশাল বিশাল পুকুর আছে প্রায় দীঘির মত । হাওড়া শিবপুরের কয়েকটি পুকুরের নাম উল্লেখ করছি । কৈ-পুকুর, দালাল পুকুর, চিনা পুকুর, বেজ পুকুর, চৌধুরী পুকুর, ভুজঙ্গা পুকুর। এই ভুজঙ্গা পুকুরটা আগে অনেক বড় ছিল । পুকুরকে দু ভাগে ভাগ করে মাঝ দিয়ে বাঁধ দিয়ে যাতায়াতের রাস্তা করা হয়েছিল । পরে পূর্ব ভাগের পুকুরটা আছে পশ্চিম দিকের পুকুর ভরাট করে বাড়ী ঘর দোর তৈরী হল ।মন্দিরতলায় যে পুকুর আছে সেটি খুব সুন্দর ভাবে তার সৌদার্যায়ন এবং সংস্কার হয়েছে যা প্রশংসনীয়। ও হাঁ ভুলেই যাচ্ছিলাম সাঁতরাগাছির বিখ্যাত ঝিলের কথা । শীত কালে এখানে বিভিন্ন পরিযায়ী পাখির সমাগম হয় । সুদূর সাইবেড়িয়া থেকেও হাজার হাজার মাইল উড়ে পাখি চলে আসতো এই জলায়। খুব দুঃখের কথা দূষণের কারণে ও নানা কারণে বিদেশী পাখি আসা অনেক কমে গেছে ।সারা হাওড়া জুড়ে গ্রামে ও শহরে এরকম বহুবিশাল পুকুর আছে । সব পুকুরের স্থান ও নাম জানা নেই। তাই তা উল্লেখ করা থেকে বিরত রইলাম । তবে আমার একটা নিবেদন রইল । সেটি হল হাওড়া শহর গ্রামে এখনো যে সব বৃহৎ দীঘি, পুকুর, ঝিল জলাশয় আছে তাদের স্থান ও নাম যারা হাওড়া নিয়ে আগ্রহী তারা জানান,তা হলে তা লিপি বদ্ধ করার সুযোগ পাবো যা পরবর্তী প্রজন্ম এর কাছে মূল্যবান নথি হয়ে থাকবে ।শেষ করি এই বলে হাওড়ার কি গ্রাম কি শহর , বহু খাল বিল দীঘি জলাশয় মজে যাচ্ছে বা বলি বুজে যাচ্ছে। যতটা না প্রাকৃতিক কারণে তার থেকে বেশী মানুষের কারণে । যার ফলে প্রকৃতি হারিয়ে ফেলছে তার ভারসাম্য। এখনো সময় আছে সর্বত ভাবে আমাদেরকে জলাশয় রক্ষা করতে হবে । আপাতত এই পর্ব শেষ। আগামী ও শেষ পর্ব হাওড়ার ভূ-বৈচিত্র ও পরিসংখ্যান।

========================
ঋণ স্বীকার :- হাওড়া জেলার ইতিহাস, প্রথম খন্ড / অচল ভট্টাচার্য।

Leave a Reply

%d bloggers like this: