Legacy of poet Bishnu Dey, Pantihal

Suddhashil Ghosh

পাঁতিহালের কবি বিষ্ণু দে..❤️❤️

পাঁতিহাল গ্রাম কবি বিষ্ণু দে’র স্মৃতি বিজড়িত। আমার বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেক দূরেই বিশ্বাসপাড়ায় অবস্থিত কবি বিষ্ণু দে’র পৈত্রিক ভিটা।বাংলা সাহিত্যের কল্লোল যুগের কবিদের মধ্যে কবি বিষ্ণু দে অন্যতম। কবির শৈশব-কৈশোর-যৌবন, শিক্ষা-দীক্ষা, কাব্যচর্চা এসব কলকাতাতে অতিবাহিত হলেও,পাঁতিহাল গ্রামের সাথে ছিল কবির নিবিড় সম্পর্ক।

আজ কবির জন্মদিন, অর্থাৎ ১৮ই জুলাই, ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পিতা ছিলেন স্বর্গীয় অবিনাশ চন্দ্র দে এবং মাতা মনোহারিনী দেবী। কবি বিষ্ণু দে চিন্তায়- মননে ছিলেন নবজাগরণের সার্থক উত্তরপুরুষ। কবি কলকাতাবাসী হলেও শিকড়ের টানে পাঁতিহালে পূর্বপুরুষের জীর্ণ ভদ্রাসনে তিনি বারবারই ছুটে আসতেন।দেশ-বিদেশের বন্ধুদের নিয়ে বসতো জমাটী আড্ডা। গ্রামের মানুষদের সঙ্গে চলতো সৌজন্য সাক্ষাৎ। অগাধ পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন তিনি। তা না হলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবৎকালে একজন আধুনিক কবি হিসাবে সুখ্যাতি অর্জন করতে পারতেন না। প্রাচ্য- প্রতীচ্যের ইতিহাস, পুরাণ, মহাকাব্য ও লোকায়ত সমাজ সংস্কৃতির ধারক-বাহক ছিলেন তিনি। ইংরেজি সাহিত্যেও তিনি দক্ষ ছিলেন দীর্ঘ তিয়াত্তর বছর বয়সে আঠারোটি কাব্য এবং প্রায় পয়ষট্টি টি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন।

পরিচয়,দেশ, চতুরঙ্গ,আনন্দবাজার,অমৃত, স্বাধীনতা,বিচিত্রা,ধূপছায়া প্রভৃতি পত্র – পত্রিকায় তিনি নিয়মিত সাহিত্য চর্চা করতেন।নিজের সুদীর্ঘ জীবনে তিনি দেখেছেন স্বদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে শাসকের শাসন ও শোষণ, দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা, দূর্ভিক্ষ, মহামারী প্রভৃতি যা তিনি তাঁর “চৈতন্যের মড়ক” এ তুলে ধরেছেন। তাঁর লেখায় গ্রাম বাংলার প্রকৃতি যেমন উঠে এসেছে তেমনি দরিদ্র, অবহেলিত, হতাশা গ্ৰস্ত সাধারণ মানুষের জীবন ও ফুটে উঠেছে। একজন সংবেদনশীল, মরমী কবি হিসেবে তাঁর কলম দিয়ে সাধারণ মানুষের চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা, প্রেম- ভালোবাসা, কবিতা, প্রবন্ধ হিসেবে ঝড়ে পড়েছে। তাঁর প্রবন্ধ সাহিত্যের মধ্যে বহু চর্চিত ও আলোচিত প্রবন্ধ গুলি হল ‘রুচি ও প্রগতি’, ‘সাহিত্যের ভবিষ্যৎ’,’এলোমেলো জীবন ও শিল্প সাহিত্য’,’সাহিত্যের দেশ -বিদেশ’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও শিল্প সাহিত্যে আধুনিক সমস্যা’,’যামিনী রায়’,’সেকাল থেকে একাল’ ইত্যাদি।

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে বুদ্ধদেব বসুর সম্পাদিত, “প্রগতি” পত্রিকায় প্রকাশিত হয় প্রথম গল্প “পুরানের পূনর্জন্ম লক্ষণ”। কবি বিষ্ণু দে, ‘শ্যামল রায়’ ছদ্মনামে ‘ধূপছায়া’পত্রিকাতে প্রথম প্রবন্ধ ‘শিল্পী গগনেন্দ্রনাথ’ প্রকাশিত হয়। ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’ এর পর একেরপর এক প্রকাশিত হয় তাঁর অনান্য কাব্যগ্রন্থ গুলি যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘চোরাবালি’, ‘পূর্বলেখ’, ‘সাতভাই চম্পা’, প্রভৃতি। অনুবাদ গ্ৰন্থের মধ্যে বিশেষ উল্লেখ্য – ‘এলিয়টের কবিতা’, ‘উদীহীন শিল্পী। ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ’ কাব্যগ্ৰন্থের জন্য কবি বিষ্ণু দে ১৯৬৫ সালে আ্যকাডেমী পুরস্কার এবং ১৯৭২ সালে “জ্ঞানপীঠ” পুরস্কারে ভূষিত হন। মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বস্ত কবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যে বিশেষ ভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

উপযুক্ত রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে, কালের করাল গ্রাসে অনেক আগেই হারিয়ে গেছে কবির পূর্বপুরুষদের সেই জীর্ণ ভদ্রাসন। এলাকার সংস্কৃতি প্রেমী মানুষজন কবির পৈত্রিক ভিটায় “বিষ্ণু দে মঞ্চ” নামে কবির নামে নামাঙ্কিত একটি নাট্যশালা স্থাপন করেছিলেন। এখনও প্রতি বছর কবির জন্মবার্ষিকীতে এলাকার মানুষদের উদ্যোগে গঠিত “শ্যামাচরণ দে স্মৃতি রক্ষা কমিটির”পক্ষ থেকে কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় এবং একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও কবি বিষয়ক আলোচনা হয়ে থাকে। কিছু মাস আগেই শ্যামাচরণ দে স্মৃতি রক্ষা কমিটি এবং গ্ৰামবাসী সহ এলাকার সংস্কৃতিমনা মানুষদের উদ্যোগে কবি বিষ্ণু দে-র পৈতৃক ভিটা সংলগ্ন জায়গায়,পাঁতিহাল বালিকা বিদ্যালয়ের উল্টো দিকে কবি বিষ্ণু দে র আবক্ষমূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। মহাসমারোহে সেই মূর্তির উন্মোচন হয়েছে। জেলা এবং জেলার বাইরের থেকে বহু মানুষ ওই দিন হাজির হয়েছিলেন পাঁতিহালে। ভাষাবিদ্ পবিত্র সরকার মূর্তিটির আবরণ উন্মোচন করেন। বিষ্ণু দে’র অগণিত গুণমুগ্ধ,তাঁর গ্ৰামের মানুষ, তাঁর পরিবারের সদস্যরা সকলেই উপস্থিত ছিলেন সেই আনন্দ মুহুর্তে। এখানে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় কবির মূর্তি নির্মাণ করেছেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী গুরুকিংকর ঢ্যাং, যিনি পাঁতিহাল গ্ৰামেরই মানুষ।

কবি বিষ্ণু দে’র স্মৃতি ধন্য গ্রাম পাঁতিহাল। এই গ্রামে শিক্ষা বিস্তারে দে- বিশ্বাস পরিবারের অবদান অনেকখানি। পরিশেষে বিশ্বাস পরিবারের আরও এক জনের কথা না বললেই নয় তিনি হলেন শ্যামাচরণ দে- বিশ্বাস। যিনি ছিলেন প্রথম ভারতীয় গেজেটেড আ্যসিন্ট্যান্ট কম্পট্রোলার। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সাথে ছিল তাঁর প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। কলকাতার বিখ্যাত রাজপথ তাঁর নামে নামাঙ্কিত করা হয়, “শ্যামাচরণ দে ষ্ট্রীট “। অতীতের কোনো চিহ্নই আজ আর অবশিষ্ট নেই। ভগ্নস্তূপ আগাছা দখল করেছে। তবে সবকিছুর মধ্যেও কবির মূর্তি স্থাপনের মাধ্যমে পাঁতিহাল গ্ৰামে কবি বিষ্ণু দে’র স্মৃতি সদা সমুজ্জ্বল হয়ে থাকবে।

আজ কবি বিষ্ণু দে’র জন্মবার্ষিকী।
বিনম্র শ্রদ্ধা ও প্রনাম মুহুর্মুহু… 🙏💐

Leave a Reply

Discover more from LAWET

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading