Ma mandala Kali of Pantihal, Howrah

Suddhashil Ghosh

পাঁতিহালের ঐতিহ্যবাহী মণ্ডলা কালী পূজা… 🌺🌺

মহাপূজার ক্ষণ সমাগত। জৈষ্ঠ্যের ফলহারিনী অমাবস্যায় পাঁতিহাল গ্রামে পূজিতা হন মা মণ্ডলা কালী। হাওড়া জেলার জগৎবল্লভপুর থানা অন্তর্গত গ্রাম পাঁতিহাল। প্রাচীনকাল থেকেই শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটেছে এই গ্রামে।পাঁতিহাল গ্রামের প্রধান উৎসব মণ্ডলা কালীর পূজা। এই পূজার সূচনা আনুমানিক সাড়ে তিনশো বছর পূর্বে। পাঁতিহাল গ্রামের বর্ধিষ্ণু ঘোষাল পরিবারে মা পূজিতা হতেন। এই পরিবারের এক পূর্বপুরুষ তন্ত্র সাধনা করতেন। এই নিয়ে পরিবারে মধ্যে মত বিরোধ হওয়ায়,গৃহে কালীপূজা বন্ধ হয়। অন্যদিকে পাঁতিহাল গ্রামের রায় পরিবারের ধর্মপ্রাণ জমিদার স্বর্গত কাঁলাচাদ রায়কে মা স্বপ্নে আদেশ দিলেন যে মণ্ডলা নামক স্থানে দিঘির (বর্তমানে যেটি মণ্ডলা পুকুর) পাশে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করতে। সেই মতো কাঁলাচাদ রায় ঘোষাল পরিবারের দ্বিতীয় পুরুষ গৃহীসাধক রামশরন ঘোষালের সহযোগিতায় রায় পরিবারের তত্বাবধানে পঞ্চমুন্ডির বেদীতে জৈষ্ঠ্য মাসের ফলহারিনী অমাবস্যায় মায়ের পূজা শুরু করলেন। মায়ের পূজার প্রচলন নিয়ে এরকম অনেক জনশ্রুতি লোকমুখে প্রচলিত। প্রথমদিকে মাটির দেওয়ালে হোগলা পাতার ছাউনি দেওয়া মন্দিরে মায়ের পূজা হত। পরবর্তী সময়ে রায় পরিবারের স্বর্গত বেচারাম রায় মহাশয় ১৩২২ বঙ্গাব্দে মায়ের মন্দির নির্মাণ করেন। মন্দির গাত্রের ফলকই তার সত্যতা প্রমাণ করে। মায়ের মন্দিরের গঠনশৈলী দালান আকৃতির, মন্দিরের সামনে প্রশস্ত নাটমন্দির, তারপর বলিদানের স্থান। মহেশ্বর শিবের মন্দির,মায়ের ঘাট, স্নানাগার,বাবা পঞ্চানন্দের মন্দির। বর্তমানে মন্দির চত্বরে (নাটমন্দির) দশমহাবিদ্যার ছবি এবং বিষ্ণুর দশাবতারের মূর্তি তৈরি হয়েছে যা সত্যিই দৃষ্টি নন্দন। সন্ধ্যা থেকেই গোটা মন্দির নানা রঙের আলোয় সেজে ওঠে।

এবার জানা যাক মায়ের মূর্তি ও পূজা পদ্ধতি। দেবী এখানে দ্বিভুজা,সমুদ্রের জলের মতো উজ্জ্বল তাঁর গাত্রবর্ণ।মায়ের একহাতে সদ্য ছিন্নমুণ্ড এবং অন্য হাতে কারন পাত্র। জিহ্বা অপ্রকাশমান, দাঁত গুলো সামনের দিকে প্রকাশিত। তিনি সদাহাস্যময়ী। মায়ের গলায় মুন্ডমালা এবং কোটি দেশে ছিন্ন নর কর অনুপস্থিত।দেবীর বাম পা সামনে এবং ডান পা পিছনে। তিনি শবরূপী শিবের উপর দন্ডায়মান। মা মণ্ডলার পূজা অনুষ্ঠিত হয় জৈষ্ঠ্য মাসের ফলহারিনী অমাবস্যায়, অন্য দিন বা প্রত্যহ হয় না। মা মন্দিরের গর্ভগৃহের ভিতরে পঞ্চমুন্ডির বেদীর উপর কাষ্ঠ নির্মিত সিংহাসনে বিরাজ করেন, তাই পূজার সময় মাকে তীরকাঠি বা সুতা দ্বারা আবদ্ধ করা হয় না। পুজোর দিন ভোর থেকে মায়ের ঘাটে উপচে পড়ে ভিড়, বহু পুণ্যার্থী মায়ের পুকুরে স্নান করেন। বহু ভক্ত সূদুর গঙ্গা থেকে হেঁটে গঙ্গাজল নিয়ে আসেন মায়ের উদ্দেশ্যে। দুপুর বেলা শোভাযাত্রা সহকারে মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তি আনতে যাওয়া হয় বালিয়া গ্রামে। অগনিত ভক্ত এই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন। মাথায় করে মায়ের মূর্তি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা সহকারে মন্দিরে আনা হয়।সে এক অপূর্ব দৃশ্য হাজার হাজার মানুষ রাস্তার দুধারে, মন্দির চত্বরে অপেক্ষা করেন। সন্ধ্যা থেকে বহু মানুষ নতুন বস্ত্র পরিধান করে মায়ের পুকুরে স্নান করে গন্ডি (ডন্ডী)কাটেন, নিজেদের অভীষ্ট পূরনের আশায়। রাত্রি দশটায় মায়ের পুজো শুরু হয়, তারপর একে একে হয় ছাগ বলিদান, আরতি, ভোগ নিবেদন, ধূনোপোড়া, বুক চিড়ে রক্ত দেওয়া প্রভৃতি। ভোর বেলায় সূর্যদয়ের আগে মায়ের মঙ্গলঘট নিরঞ্জন করা হয়। মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তি অম্বুবাচী নিবৃত্তির এক সপ্তাহ পরে যে শনিবার আসে সেদিন বিকালে নিরঞ্জন দেওয়া হয়।

মা মণ্ডলাকে নিয়ে ছড়িয়ে আছে নানা কিংবদন্তি। আজ থেকে বহু বছর পূর্বে মায়ের ঘাট থেকে একটি বড়ো খড়্গ পাওয়া গিয়েছিল। সেই খড়্গ দিয়ে পুজোর সময় প্রথম তিনটি বলি করা হত। বর্তমানে অবশ্য হয় না। কিন্তু আজও পুজোর সময় সেই খড়্গ মন্দিরে আনা হয়। বলিদানের প্রথম তিন কোপের মাটি, রায় বাড়িস্থিত ঘোষ পরিবারে রক্ষিত থাকে। বহু মানুষ দূরারোগ্য ব্যাধি নিরাময়ের জন্য মায়ের ওই মাটি দৈব ওষুধ হিসেবে গ্ৰহণ করেন।মায়ের পুজোর এক মাস আগে অর্থাৎ, বৈশাখী অমাবস্যায় মায়ের কাঠামোতে নব মৃত্তিকা দেওয়া হয়। সেই অনুষ্ঠানটিকে বলা হয় কাঠামো পূজা বা গায়ে মাটি। পুজো শুরুর কয়েক বছর পর এমনি এক দিনে কালাচাঁদ রায় নিজেদের পারিবারিক কিছু কাজ নিয়ে কোর্টে যাচ্ছিলেন। পথে হঠাৎই এক কিশোরী মেয়ে তার পথ আটকায়। সেই কিশোরী কালাচাঁদকে বলেন “অমাবস্যা যে চলে যাচ্ছে, কখন আমার কাঠামোতে নব মৃত্তিকা দিবি। ” সেই মেয়ে আরও বলেন তুই যে কাজে যাচ্ছিলিস সেই কাজে সফল হবি, তুই বাড়ি ফিরে যা গিয়ে কাঠামো পুজোর ব্যবস্থা কর।কালাচাঁদ রায় তড়িঘড়ি ফিরে এসে, পাঁতিহাল গ্রামের স্বর্গত প্রিয়নাথ ঘোষালকে দিয়ে মায়ের গায়ে মাটি দেন। সেই থেকে আজও বংশপরম্পরায় ওই পরিবারের বংশধররা মায়ের গায়ে মাটি দেন এবং মায়ের পুজোয় তন্ত্রধারকের আসন অলংকৃত করেন। এবং মুন্সীহাট নবাসন নিবাসী স্বর্গত যতীন ভট্টাচার্য মায়ের স্বপ্নাদেশেই মায়ের পুজোয় পূজারী হিসেবে নিযুক্ত হন। তাঁর বংশধররা আজও এই ধারা বজায় রেখেছেন।

পাঁতিহাল গ্রামের এবং পাশ্ববর্তী গ্রামের বহু মানুষ পুরুষানুক্রমে এই পুজোর সাথে যুক্ত আছেন। যেমন- টহলদার পাকুড়, পন্ডিত, মালিক ও সর্দার পদবীধারী মানুষরাই মা কে মৃৎশিল্পর গৃহ থেকে মন্দিরে নিয়ে আসেন পায়ে হেঁটে। প্রতিমা শিল্পী বালিয়া গ্রামের স্বর্গত কিশোরী মোহন দাস এবং যুগোল দাস । ওনারাই পরম নিষ্ঠায় মায়ের রূপদান করেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতিমা তৈরির পেশা ছিল না। মায়ের স্বপ্নাদেশেই তারা এই পেশায় আসেন এবং মায়ের মূর্তি গড়া শুরু করেন। স্বর্গত অটলবিহারী চক্রবর্তীর পরিবার মায়ের প্রতিমার মূল্য হিসাবে আজও ষোলআনা অর্থাৎ, এক টাকা প্রতিমা শিল্পীর হাতে দেন। এছাড়াও ঢাকি-ঢুলি,কামার, কুমোর, মালাকার, গোয়ালা, ভোগ রান্নার পুরোহিত তারা প্রত্যেকেই তাদের দায়িত্ব বংশানুক্রমে পালন করছেন। মায়ের পুজো উপলক্ষে বসে বিরাট মেলা, লক্ষাধিক ভক্তসমাগম হয় পুজোয়। গোটা গ্রাম আলোক মালায় সেজে ওঠে। উৎসবের আকার নেয় পাঁতিহাল গ্রাম। পুজোর এক সপ্তাহ পর থেকে শুরু হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আগে মায়েরনাটমন্দিরে কলকাতার বহু খ্যাতনামা অপেরা তাদের যাত্রাপালা মঞ্চস্থ করে গেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল নট্ট কোম্পানি, রঞ্জন অপেরা, গনেশ অপেরা, সত্যম্বর অপেরা প্রভৃতি। মঞ্চস্থ হয়েছে পলাশীর মেয়ে, মায়ের দেশ, চন্দ্র হাসের মতো কালজয়ী সব যাত্রাপালা। যাত্রা জগৎের বহু খ্যতনামা অভিনেতা-অভিনেত্রী এই আসরে অভিনয় করেছেন, যেমন সত্যেন বোস, তিনকড়ি ভট্টাচার্য, পান্না চক্রবর্তী, ফনী বিদ্যাবিনোদ কে নেই সেই তালিকায়। রায় বাড়ির দুর্গা দালানে সাজঘরের আসর বসতো। বাঁখাড়ি দিয়ে ঘেরা হতো মঞ্চ, খালি গলায় ডে-লাইটের আলোয় হত যাত্রা। নারকেল পাতা দিয়ে তৈরি করা হত দর্শক আসন। পরবর্তীতে অপেরা পার্টির যাত্রা বন্ধ হলে গ্রামের আ্যমেচার ক্লাব গুলি বহু যাত্রা মঞ্চস্থ করে। অচল পয়সা, পাগলা গারদ, রাইফেল, কুরুক্ষেত্রের কৃষ্ণ পৃথ্বীরাজ এসব যাত্রাপালার দৃশ্য গুলো আজও এলাকাবাসীর চোখে ফুটে ওঠে। এখনও দুই-তিন দিন ব্যাপী যাত্রা, নাটক মঞ্চস্থ হয়। মায়ের পূজা উপলক্ষে হয় অন্নকূট মহোৎসব। বহু মানুষ ওই দিন মায়ের অন্ন প্রসাদ গ্ৰহণ করতে আসেন।

জনমানসে মা মণ্ডলার স্থান অসীম।বহু ভক্ত দূর-দুরান্ত থেকে আসেন বিভিন্ন মনস্কামনা নিয়ে। মায়ের কৃপায় মনস্কামনা পূর্ণ হলে তারা সাধ্যমতো মায়ের কাছে পুজো দেন। মণ্ডলা কালীর পুজো উপলক্ষে পাঁতিহাল গ্রামের সব বাড়িই আত্মীয় পরিজনে ভরে ওঠে। এলাকায় কোনো শুভ কাজ হলে সবার আগে মায়ের স্মরণ করা হয়। এলাকাবাসীর অভিভাবক হিসেবে তিনি পাঁতিহালে বিরাজ করছেন। পাঁতিহাল মহেশতলা বারোয়ারি বছরের পর বছর ধরে হাওড়া জেলার অন্যতম প্রাচীন এই পুজোকে সুনামের সাথে আয়োজন করে চলেছেন। মা মণ্ডলার অপার মহিমা,এলাকার প্রতিটি মানুষের মুখে মা মণ্ডলাকে নিয়ে নানা মাহাত্ম্য প্রচলিত আছে। এই ভাবেই ঐতিহ্য ও পরম্পরাকে অক্ষুন্ন রেখে মা মণ্ডলা,পাঁতিহাল গ্রামের প্রানের দেবী হিসেবে পূজিতা হচ্ছেন।

তথ্যসূত্র:
মণ্ডলাকালীর ইতিবৃত্ত:শুদ্ধশীল ঘোষ
(ব্যক্তিগত ক্ষেত্রসমীক্ষা)

2 responses to “Ma mandala Kali of Pantihal, Howrah”

  1. I’m unable to read you post but enjoy your devotional statue.

    1. Ma Mondala Kali is the form of Adyasakti Mahamaya, The temple of Mondala kali can be reached by taking Amta Local from Howrah Station to Pantihal. Then toto/ auto will take you to this temple. Ma Mondala Kali give darshan to the devotees only for one month- May to June every year.

Leave a Reply

%d bloggers like this: