জয় জগদ্ধাত্রী

একটি উৎসর্গীকৃত লেখা

জগদ্ধাত্রীর ধ্যানমন্ত্রে দেবীর যে রূপকল্পনা করা হয়েছে তা নিম্নরূপ:

ওঁ দূং সিংহস্কন্ধসমারূঢ়াং নানালঙ্কারভূষিতাম্।
চতুর্ভুজাং মহাদেবীং নাগযজ্ঞোপবীতিনীম্॥
শঙ্খশার্ঙ্গসমাযুক্তাং-বামপাণিদ্বয়ান্বিতাং।
চক্রঞ্চ পঞ্চবানাঞ্শ্চ ধারয়েতঞ্চ দক্ষিণে॥
রক্তবস্ত্রপরিধানাং বালার্কসদৃশদ্যুতিম্।
নারদাদ্যৈর্মুনিগণৈঃ সেবিতাং ভবসুন্দরীম্॥
ত্রিবলীবলয়োপেত-নাভিনালমৃণালিনীম্।
ঈষৎসহাস্যবদনাং কাঞ্চনাভাং বরপ্রদাম্॥
নবযৌবনসম্পন্নাং পীনোন্নতপয়োধরাম্।
করুণামৃতবর্ষিণ্যা পশ্যন্তীং সাধকং দৃশা॥
রত্নদ্বীপে মণিদ্বীপে সিংহাসনসমন্বিতে।
প্রফুল্লকমলারূঢ়াং ধ্যায়েত্তাং ভবগেহিনীম্।
বিচিন্তয়েৎ জগতাং ধাত্রীং ধর্ম্মাকামার্থ মোক্ষদাম্।।
ওঁ দূং শ্রীমদ্জগদ্ধাত্রীদুর্গায়ৈ নমঃ॥

অর্থ: দেবী সিংহস্কন্ধে আরূঢ়া, নানা অলঙ্কারে অলংকৃতা, চতুর্ভুজা, মহাদেবী, সর্পকে যজ্ঞোপবীত রূপে পরিধান করে আছেন। বাম হাত দুটিতে তাঁর শঙ্খ এবং ধনুক, দক্ষিণ হাত দুটিতে চক্র এবং বাণ। পরিধানে রক্তবস্ত্র, তাঁর বর্ণ প্রাতঃ সূর্যের ন্যায় লাল। তিনি জগতের শ্রেষ্ঠসুন্দরী, নারদ প্রভৃতি মুনিগণ তাঁর সেবা করেন। তাঁর উদর নাভিপদ্মের মৃণালের মতো লোমাবলী বলায়াকার ত্রিবলীর সঙ্গে যুক্ত। তিনি মৃদুহাস্যবদনা, দেহের বর্ণে সুবর্ণের আভায় বরদায়িনী। তিনি নবযৌবনসম্পন্না, পীন ও উন্নত পয়োধরা। তিনি করুণা এবং অমৃতবর্ষী দৃষ্টিতে সাধককে দেখেন। রত্নময় দ্বীপে মহাদ্বিপে যে সিংহাসন রয়েছে তার উপর প্রফুল্ল কমলে তিনি উপবিষ্টা। যিনি এই ভবগৃহের স্বামিনী, ভবের ঘরনি সেই জগদ্ধাত্রী দুর্গাকেই ধ্যান করি। 

Jagaddhatri puja in my locality

জগদ্ধাত্রী দেবী দূর্গার তথা পার্বতীর অপর রূপ। তাঁকে হৈমন্তিকা তথা হৈমবতী ও বলা হয়। বিভিন্ন তন্ত্র ও পুরাণ গ্রন্থেও তার উল্লেখ পাওয়া যায়। যদিও জগদ্ধাত্রী আরাধনা বিশেষত বঙ্গদেশেই প্রচলিত।কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দেবী জগদ্ধাত্রীর বাৎসরিক পূজা অনুষ্ঠিত হয়।

জগদ্ধাত্রী দেবীর প্রতিমার তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্বামী নির্মলানন্দ বলেছেন, “অর্ক বা সূর্যই বিশ্বের পোষণকর্তা। পৃথিব্যাদি আবর্তনশীল গ্রহ-উপগ্রহদিগকে সূর্যই নিজের দিকে আকর্ষণ করে রেখেছেন। দেবী জগদ্ধাত্রীর মধ্যেও ধারণী ও পোষণী শক্তির পরিচয় বিদ্যমান। তাই তাঁকে বলা হয়েছে বালার্কসদৃশীতনু। একই কারণে জগৎপালক বিষ্ণুর শঙ্খ-চক্র-শার্ঙ্গধনু-আদি আয়ুধ দেবীর শ্রীকরে। দেবীর রক্তবস্ত্র ও রক্তবর্ণের মধ্যে, দেবীর সিংহাসনস্থ রক্তকমলে সেই রজোগুণেরই ছড়াছড়ি। রজোদীপ্ত বলেই জগদ্ধাত্রী মহাশক্তিময়ী। তাঁর অস্ত্রশস্ত্র, তাঁর বাহন – সকলই তাঁর শক্তিমত্তার ভাবটি আমাদের অন্তরে উদ্দীপ্ত করে দেয়। তবে দেবীর এই বীর্য সংহারের নয়। পরন্তু সমগ্র বিশ্বকে মহাসর্বনাশ থেকে রক্ষাপূর্বক তাকে আত্মসত্তায় – ঋতে ও সত্যে সুস্থির করে রাখবার জন্য। নাগ বা সর্প যোগের পরিচায়ক। উপবীত ব্রাহ্মণ্যশক্তির প্রতীক। দেবী জগদ্ধাত্রী ব্রহ্মময়ী; তিনি পরমা যোগিনী। মহাযোগবলেই ব্রহ্মময়ী ধরে আছেন এই নিখিল বিশ্বসংসারকে। এই জগদ্ধারণই জগদ্ধাত্রীর পরম তপস্যা – তাঁর নিত্য লীলা, তাঁর নিত্য খেলা। জননীরূপে তিনিই বিশ্বপ্রসূতি, আবার ধাত্রীরূপে তিনিই বিশ্বধাত্রী।”

পুরাণে কথিত আছে একদা ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু ও চন্দ্র – এই চার দেবতা অহংকার-প্রমত্ত হয়ে নিজেদের ঈশ্বর মনে করতে শুরু করলেন। তারা বিস্মৃত হলেন যে দেবতা হলেও তাদের স্বতন্ত্র কোনও শক্তি নেই – মহাশক্তি পার্বতীর শক্তিতেই তারা বলীয়ান। দেবগণের এই ভ্রান্তি অপনয়নের জন্য দেবী জগদ্ধাত্রী ( পার্বতী) কোটি সূর্যের তেজ ও কোটি চন্দ্রের প্রভাযুক্ত এক দিব্য মূর্তিতে তাদের সম্মুখে উপস্থিত হলেন। এর পরের কাহিনি কেন উপনিষদে বর্ণিত তৃণখণ্ডের কাহিনির অনুরূপ। দেবী প্রত্যেকের সম্মুখে একটি করে তৃণখণ্ড রাখলেন; কিন্তু চার দেবতার কেউই তাকে স্থানচ্যুত বা ভষ্মীভূত করতে অসমর্থ হলেন। দেবগণ নিজেদের ভুল উপলব্ধি করলেন। তখন দেবী তার তেজোরাশি স্তিমিত করে এই অনিন্দ্য মূর্তি ধারণ করলেন। এই মূর্তি ত্রিনয়না, চতুর্ভূজা, রক্তাম্বরা, সালংকারা, নাগযজ্ঞোপবীতধারিনী ও দেব-ঋষিগণ কর্তৃক অভিবন্দিতা এক মঙ্গলময়ী মহাদেবীর মূর্তি। সমগ্র জগৎকে পরিব্যাপ্ত করে দেবী দেবগণকে এই মূর্তি দেখালেন; দেবগণও তার স্তবে প্রবুদ্ধ হলেন। 

Burima in Krishnanagar Rajbari

কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির মতে এই পূজা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০ খৃষ্টাব্দ) দ্বারা শুরু হয়েছে। তিনি নাকি তৎকালীন নবাবের কাছে কোন এক কারণে দুর্গা পূজার সময়ে বন্দি হন এবং পরে দুর্গা পূজার পর ছাড়া পেলে স্বপ্নাদেশে পরের মাসের অর্থাৎ কার্তিক শুক্লা নবমীতে এই পূজার প্রচলন করেন।

কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ছিলেন গিরীশচন্দ্র রায়। তিনি নদীয়ার শান্তিপুরের কাছে ১০৮ঘর ব্রাহ্ম পরিবারকে থাকতে দিয়ে একটি গ্রামপত্তন করেন যার নাম “ব্রাহ্মশাসন”। তার পর থেকে শুরু হয় শান্তিপুরে জগদ্ধাত্রী পুরো প্রচলন।

জগদ্ধাত্রী পূজা কেউ কেউ সপ্তমী থেকে নবমী অবধি দুর্গাপূজার ধাঁচে করে থাকেন। আবার কেউ কেউ নবমীর দিনই তিন বার পূজার আয়োজন করে সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পূজা সম্পন্ন করেন। এই পূজার অনেক প্রথাই দুর্গাপূজার অনুরূপ।

দেবীর নানাবিধ অলঙ্কার ঐশ্বর্যের প্রতীক যা একত্রে অষ্টপ্রকার বিভূতি এবং প্রভুত্বকে প্রকাশ করে। ত্রিগুনাত্বিকা মা আমাদের অনন্ত কোটি ব্রহ্মাণ্ড পালিকা ও চালিকা। দেবীর হাতে যে চক্র বর্তমান তা এই ব্রহ্মান্দের প্রতীক যা সর্বক্ষণ ঘূর্ণায়মান, কিন্তু তা সম্ভব শুধুমাত্র দেবীর অঙ্গুলিহেলনে। দেবীর মায়াতেই এই বিশ্বসংসার সৃষ্টি, স্থিতি, লয়ে হচ্ছে কিন্তু তিনি পরমব্রহ্ম তাই এসবের উর্ধে (ঠিক যেভাবে চক্র তার আঙ্গুল স্পর্শ করে না)। তার ওপর হাতে শঙ্খ, যা শব্দের প্রতীক, শব্দই নাদ, নাদই ব্রহ্ম। তিনি বাক রুপেও নিজেকে ভক্ত প্রানে প্রকাশ করেন। দেবীর হাতের ধনুক হোল অসিম চৈতন্য শক্তির প্রতীক যা আদ্যা জননীর প্রকাশ আবার সেই চেতনা যখুন ক্রিয়াশীল হয়ে মানুষের লক্ষ প্রাপ্তি, সমাজ কল্যান ইত্যাদি কাজে উদ্ভূত হয়, তাই তির বা বাণ। এই ছিলা টিও জগত জননী বেঁধে দেন সাধু জনের অন্তরে।

ধ্যান বা স্তবমন্ত্রে উল্লেখ না থাকলেও জগদ্ধাত্রী প্রতিমায় বাহন সিংহের পদতলে একটি হস্তীমুণ্ড থাকে। পুরাণে বর্ণিত দেবী মহাহস্তী রূপী করিন্দ্রাসুর কে বধ করেন। আসলে এই অসুর অসংযত মন। যে কোন সাধনায় নিজের মন কে সংযত করতে না পারলে সিদ্ধিলাভ অসম্ভব হয়ে যায়।


জগদ্ধাত্রী পূজা পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর, শান্তিপুর, হুগলী জেলার চন্দননগর, মানকুন্ড, ভদ্রেশ্বর, রিষড়া তে জগত বিখ্যাত। বিশেষত হুগলীর চন্দননগরে সুউচ্চ প্রতিমা, রকমারি আলোক সজ্জা ও মন্ডপসজ্জা দেখতে ভারতের অন্য রাজ্যের মানুষ তথা  বিদেশের মানুষ ভীড় করেন।

Ramayan characters are displayed in the saj of holy mother


Leave a Reply

%d